অবশেষে পঞ্চসায়ার কাণ্ডের পর্দা ফাঁস হল। তদন্তে উঠে এলো দুজন ব্যাক্তির নাম। যতদূর জানা যাচ্ছে নির্যাতিতাকে গাড়িতে তোলার আগে থেকেই উত্তম রামের ট্যাক্সির পিছনের আসনে বসে ছিল দ্বিতীয় অভিযুক্ত। শুধু তাই নয়, নাবালক সেই অভিযুক্তই প্রথম ধর্ষণ করে নির্যাতিতাকে!

পঞ্চসায়ার হোমের আবাসিককে গণধর্ষণের ঘটনার তদন্ত গত কয়েক দিনে নতুন নতুন মোড় নিয়েছে। তদন্তকারীদের কাছে ধৃত উত্তম রাম স্বীকার করেছে, গত বুধবার, তদন্তের দ্বিতীয় দিন যখন ডিসি (পূর্ব) নিজে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন, তখন পুলিশের উপর দূর থেকে নজর রেখেছিল সে। কেন? পুলিশের কাছে উত্তম দাবি করেছে, কোন পথে তদন্ত এগোচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করেছিল সে।

বৃহস্পতিবার এক তদন্তকারী বলেন, ‘‘এই গণধর্ষণ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে প্রথম থেকে সবচেয়ে প্রতিকূল অবস্থা তৈরি হয়েছিল নির্যাতিতার বক্তব্যে। মানসিক ভাবে পুরো সুস্থ না হওয়ায়, তাঁর বক্তব্য ছিল টুকরো টুকরো। অনেক জায়গায় অস্বচ্ছ। পর পর ঘটনাগুলো মেলানো যাচ্ছিল না।” একই সঙ্গে যে হোমে তিনি থাকতেন, সেই হোমের কর্মীরা প্রথম থেকেই ভুল তথ্য দিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছিল বলেও ওই তদন্তকারীর দাবি। তাঁর কথায়, ‘‘ফলে কখন নির্যাতিতা হোম ছেড়ে বেরিয়েছিলেন, তা নির্দিষ্ট করতেই অনেকটা সময় কেটে যায় আমাদের।’’

সব মিলিয়েই তদন্তকারীদের মনে প্রথম দিকে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। এক এক সময় তাঁদের মনে হয়েছে, নির্যাতিতা হয়তো কোনও ঘোরের মধ্যে ছিলেন। ওই তদন্তকারী জানাচ্ছেন, ঘটনাক্রম ঠিক কী ছিল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও নির্যাতিতা প্রথম থেকে নিজের কয়েকটি বক্তব্যে স্থির ছিলেন। এক, তাঁর উপর নির্যাতন চালিয়েছে দু’জন। দুই, যারা তাঁর উপর অত্যাচার করেছিল, তারা তাঁকে একটি সাদা গাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তবে তার মধ্যেই তদন্ত নতুন মোড় নেয় যখন কলকাতা পুলিশ জানতে পারে, ঘটনার রাতে ওই নির্যাতিতাই নরেন্দ্রপুর থানায় শ্লীলতাহানির একটি অভিযোগ করেছিলেন। সেখানেও তিনি দু’জন অভিযুক্তের কথা বলেছিলেন। ওই তদন্তকারীর কথায়, ‘‘নির্যাতিতার বয়ানে কিছু জায়গায় অস্বচ্ছতা থাকলেও, সিসি ক্যামেরার দৌলতে আমরা নিশ্চিত হই যে নির্যাতিতাকে যে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সেই গাড়িটি একটি সাদা ট্যাক্সি।”

সেখান থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে, ঘটনা একটা ঘটেছিল। সেই সূত্র ধরে এগোতে এগোতেই পুলিশের হাতে পাকড়াও হয় ট্যাক্সিচালক উত্তম রাম। উত্তমও কিন্তু প্রথম থেকে ভুল তথ্য দিয়ে গিয়েছে পুলিশকে। ওই তদন্তকারী বলেন, ‘‘উত্তম জেরার মুখে প্রথম থেকে দাবি করেছে, সে একাই ছিল। তার সঙ্গে কেউ ছিল না।’’ অন্য দিকে, সিসি ক্যামেরার বিভিন্ন ফুটেজের কোথাও ওই গাড়িতে দ্বিতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব না পাওয়া যাওয়ায় পুলিশও একটা সময় সন্ধিহান হয়ে পড়ে। আদৌ দ্বিতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল তো!

এর মধ্যেই ফের মোড় ঘোরে তদন্তের। ওই তদন্তকারী বলেন, ‘‘উত্তম জেরায় শুরুর দিকে বলেছিল, সে রাতে মদ কিনতে বেরিয়েছিল। সেই সময়েই উত্তম বলে, সে এক বন্ধুর সঙ্গে কাঠিপোতা এলাকাতে মদ খাচ্ছিল।” সেই সূত্র ধরেই পুলিশ ওই বন্ধুকে পাকড়াও করে আনে। ওই বন্ধুর কাছ থেকে জানা যায়, ঘটনার দিন বিকেল ৪টে পর্যন্ত উত্তম তার সঙ্গে মদ খায়। তার পর উত্তম চলে যায় বাড়ি। ফের মদ খেতে আসে ৮টার সময়। উত্তমের বন্ধুর কাছ থেকেই পুলিশ প্রথম জানতে পারে, ওই রাতে ‘বাচ্চা’কে সঙ্গে নিয়ে মদ খেতে গিয়েছিল উত্তম। সাড়ে ১০টার সময় ওই ‘বাচ্চা’কে সঙ্গে নিয়েই বেরোয় মদ কিনতে।

কিন্তু প্রথম থেকেই সঙ্গীর কথা অস্বীকার করছিল উত্তম। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার সকালে দ্বিতীয় বার ঘটনার পুনর্নির্মাণের সময় যখন তদন্তকারীরা উত্তমকে জিজ্ঞাসা করেন, কোথায় সে নির্যাতিতার উপর অত্যাচার করেছিল? তখন সে গাড়ির কথা বলে। উত্তম জানায়, গাড়ির সামনের আসনে হেলান দেওয়ার অংশ শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল নির্যাতিতাকে। ঠিক তখনই তার মুখ দিয়ে সঙ্গী ‘বাচ্চা’র কথা বেরিয়ে যায়। সেই সূত্র ধরেই পুলিশ বুধবার রাতে গ্রেফতার করে নাবালক ওই অভিযুক্তকে।

তদন্তকারীদের দাবি, জেরায় ‘বাচ্চা’ স্বীকার করে প্রথম থেকেই সে গাড়ির পিছনের আসনে বসে ছিল। ওই তদন্তকারী বলেন, ‘‘গাড়ির পিছনের জানলার কাচ বন্ধ থাকায় সিসি ক্যামেরাতে কোথাও উত্তমের সঙ্গীর অস্তিত্ব চোখে পড়েনি।’’ পুলিশের দাবি, জেরায় ওই নাবালক স্বীকার করেছে যে, সেই প্রথম ধর্ষণ করে মহিলাকে। পরে একই কাজ করে উত্তম।

বৃহস্পতিবার জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সামনে পেশ করা হয় নাবালক ধৃতকে। সেখানে পুলিশের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়, ধৃতের অপরাধ যে হেতু মারাত্মক এবং তার বয়স ১৬ বছরের বেশি, তাই সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং বর্তমান আইন হিসেবে অভিযুক্তকে সাবালক হিসাবে গণ্য করা হোক। এ দিন আদালত পুলিশকে আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে অভিযুক্তের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে বিশদ রিপোর্ট জমা দিতে বলে। সেই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই আদালত বিশেষজ্ঞদের দিয়ে অভিযুক্তের মানসিক পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেবে যে, তাকে সাবালক হিসাবে গণ্য করা হবে কি না। তত দিন সরকারি হোমে রাখা হবে অভিযুক্তকে।

কিন্তু সবশেষে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় ধর্ষণের মত মারাত্মক অভিযোগ যার বিরুদ্ধে তার বয়স যাই হোক না কেন তাকে কি নাবালক বলা চলে?

 

 

 

మరింత సమాచారం తెలుసుకోండి: