দেশজুড়ে বিজেপি–আরএসএসের তথাকথিত দেশভক্তদের উল্লাসে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী মানুষরা দিশেহারা । তবে আশার আলো হিসাবে দেখা দিয়েছে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভার ফলাফল । সাধারন মানুষ যে আরএসএস –বিজেপির কথিত দেশভক্তির চেয়ে রুটি–রুজির দিকে বেশি নজর দিতে চাইছে তার সংকেত হল এই নির্বাচনের ফলাফল । কিন্ত তা সত্ত্বে বলা যাবে না গেরুয়াপন্থীদের দাপট কমে গেছে , বরং বলা যেতে পারে তারা হোঁচট খেয়েছে মাত্র । তাদের আদর্শ ও নীতি এখনও জারি রয়েছে । কীভাবে এল হিন্দুত্বের শ্লোগান নিয়ে দেশের রাজনীতিতে আরএসএসের দাপট ? এর নেপথ্যে কোন কোন রাজনৈতিক দল গোপনে বা প্রকাশ্যে বিজেপিকে মদত দিয়েছে । আরএসএস–বিজেপির শিকড় কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে প্রবেশ করল তা নিয়ে কলম ধরেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ , রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারন সম্পাদক ড. আবদুস সাত্তার । বাংলার জনরব নিউজ পোর্টালে তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে । আজ  ষষ্ঠ কিস্তি ।
প্রকাশিত অংশের পর …

সাভারকারের সংজ্ঞা অনুযায়ী , কেবলমাত্র সে-ই হিন্দু হওয়ার যোগ্য যে বেদ বর্ণিত সপ্ত হিন্দুস্থান বা ভারতবর্ষকে নিজের পিতৃভূমি ও পুণ্যভূমি বলে মনে করে এবং যার আদি ভাষা সংস্কৃত । তাঁর ভাবনা –ভাষ্যে ভাষার বিষয়টিও পরিস্কার হয়ে গেছে । কেননা , উর্দু ভাষা সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত হয়নি, আবার দেবনাগরী লিপিতেও লেখা নয়। তাঁর মতে , হিন্দুর পক্ষে উর্দুভাষী হওয়া সম্ভবপর নয় । প্রসঙ্গত , কমরেড মুজফ্ফর আহমদ-এর  ‘ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় ( ৩য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা , বৈশাখ ১৩২৭ ) লেখা একটি অংশ এই আলোচনায় আমাদের সহায়ক হতে পারে ।

‘কাকাবাবু’র লেখনিতে –
‘ এখানে আমি হিন্দু সমাজকে লক্ষ্য করিয়া একটি কথা বলিব । মুসলমান হিন্দুকে যতটা জানেন , হিন্দু মুসলমানকে ততটা জানেন না । কিন্ত তাহাদের জানা উচিত । তাহা না হইলে পাশাপাশি বাস করিয়াও একে অন্য হইতে দূরে দূরে থাকিয়া যাইবে । বর্তমান জগতের হিন্দুগণ , বিশেষ করিয়া বাঙালি হিন্দুগণ Culture- র ( কর্ষনার) দিক দিয়া নগন্য নহেন ; জ্ঞানের পিপাসা মিটাবার জন্য হিন্দুগণ ফরাসী , জার্মান ও রুসীয় ভাষা পর্যন্ত শিক্ষা করিতেছেন কিন্ত আমি একবার জিজ্ঞেস করতে পারি কি আজ পর্যন্ত কয়জন হিন্দু ইসলামী সভ্যতা চর্চা করিবার জন্য আরবী শিক্ষা করিয়াছেন ? ইসলামী সভ্যতাও নিতান্ত খেলো জিনিস নয় । এতবড় যে ইউরোপীয় সভ্যতা তাহার মূলেও রহিয়াছে ইসলামী সভ্যতা । বাস্তবিক ইহাতে জ্ঞান পিপাসু হিন্দুগণের শুধু অনুদারতা নহে , একটুকু বিদ্বেষের ভাবও যেন প্রকাশ পাইতেছে ।’
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক ( আর এস এস ) কথিত যে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ  তারও তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণ ‘ বীর ‘ সাভারকার করেছিলেন । এই মতাদর্শে দেশপ্রেমের চেয়ে  বড় বিষয় হচ্ছে সংস্কৃতি । যার প্রধান উপাদান হচ্ছে ধর্ম , মুখ্যত আর্য ধর্ম । এই ধারনায় বিভাজন একটা অনিবার্য পরিণতি হিন্দুর সঙ্গে শুধু মুসলমানের নয় , নিম্নবর্ণের মানুষও কোথাও একসাথে মিলতে পারেন না ।। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে , সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী এই বিভাজনের ধারা , পথকে উন্মুক্ত প্রান্তরে বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথমে নিয়ে এসেছেন । তাঁর মতে , এক পক্ষে আর্য ও আর্যদের সঙ্গে নানা সম্পর্কে যুক্ত আর অন্য পক্ষে মুসলমান রয়েছে । মনে রাখতে হবে , নিজেদের ‘ আর্য ‘শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে নাৎসী জার্মানিও এই কাজ করেছিল ।

সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের ধারণা দ্বিজাতিতত্ত্বের পক্ষে ভীষণভাবেই সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে । শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪ সালে মুসলিম লিগের দেশভাগকারী পাকিস্থান দাবিকে সমর্থন করে সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক নেতা আবুল মনসুর আহমদ –এর আত্মজীবনীতেও এই মতের প্রতিফলন লক্ষণীয়ভাবে ফুটে উঠেছে । তাঁর ভাষায় ,-
‘ আমি বলিয়াছিলাম পাকিস্থান দাবীটা প্রধানতঃ কালচারের অটনমির দাবী । বলিয়াছিলাম রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার চেয়েও কালচারের অটনমি অধিক গুরুত্বপূর্ণ । এইদিক হইতে পাকিস্তানের দাবী শুধু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাবী নয় , এই গোটা ভারতের কালচারাল মাইনরেটির জাতীয় দাবী ।’
সাংস্কৃতিক পার্থক্য , সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যজনিত দাবীযুক্ত যে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ তা যেমন সাভারকারের ভাষায় হিন্দু রাষ্ট্র , তেমনিভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রেও প্রেরণাদায়ক হিসাবে হাজির হয়েছে । ধর্ম ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য বিষয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে মহম্মদ আলি জিন্নাহ ও কবি মহম্মদ ইকবাল-ও সহমত পোষণ করেছেন । তারই পরিণতিতে লাঞ্ছিত , শোষিত , নিপীড়িত দেশবাসীর সর্বাঙ্গীন মুক্তির  সংগ্রাম আর অখন্ডিত থাকেনি , ধর্মের ভিত্তিতে খন্ডিত হয়ে গেছে । পারস্পরিক দ্বন্দ্ব শত্রুতায় পর্যবসিত হয়েছে ।
স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত দেশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পথে ঠেলে দিয়েছে । তাই স্বাধীনতা নয় , ক্ষমতার হস্তান্তরই আমাদের জীবনবেদ হয়ে দেখা দিয়েছে । পাঞ্জাব ও বাংলা দ্বিখন্ডিত হওয়ার কারণে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় সীমায়িত দুই পারের সংখ্যালঘু মানুষজনই পরিণত হয়েছে ‘ বধ্যভূমি’র বাসিন্দায়। ভারত ভাগ হয়েছে কিন্ত জাতি ও শ্রেণি সমস্যার সমাধান আজো অধরা থেকে গেছে । আর এই সমস্যার সমাধান হয়নি বলে সাম্প্রদায়িকতার নির্মূলকরণও ঘটেনি । জনগনের অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাও বিনষ্ট হয়েছে । ফলত , ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত কল্যাণকামী রাষ্ট্রভাবনা , শোষণমুক্তির বিষয়টি আজো অধরাই রয়ে গেছে ।

మరింత సమాచారం తెలుసుకోండి: